নারী — একটি শব্দ নয়, এটি এক শক্তি, এক অনুভূতি, যেখানে মিশে আছে মমতা, ভালোবাসা, ত্যাগ আর সাহসের অমলিন ছাপ। দীর্ঘকাল ধরে নারীরা পরিবার ও গৃহকেন্দ্রিক ভূমিকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন, কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে এবং আধুনিক বিশ্বের গতিময় প্রেক্ষাপটে তারা আজ ঘর পেরিয়ে পা বাড়াচ্ছেন সমাজ, রাষ্ট্র ও বৈশ্বিক অঙ্গনের নানা ক্ষেত্রে। নারীর ভূমিকা শুধু গৃহিণী হিসেবে নয়, বরং সফল উদ্যোক্তা হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। বর্তমান যুগ তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। এই যুগে নারীরা ঘরে বসেই ব্যবসা পরিচালনা করছেন, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করছেন অন্য নারীদের জন্যও। নারী উদ্যোক্তা হওয়া মানে শুধু অর্থনৈতিক মুক্তি নয়, বরং আত্মমর্যাদা, আত্মবিশ্বাস ও সামাজিক সম্মান অর্জনের পথও।
বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হচ্ছে ধীরে ধীরে। তবুও এখনো অনেক নারী জানেন না, কীভাবে উদ্যোক্তা হওয়া যায়, কোথা থেকে শুরু করতে হবে, কী ধরণের ব্যবসা উপযুক্ত হবে। এই রচনায় আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব নারী উদ্যোক্তা হওয়ার পদ্ধতি, প্রস্তুতি, চ্যালেঞ্জ ও সফলতার কৌশল নিয়ে।
নারী উদ্যোক্তা হওয়ার গুরুত্ব
নারী উদ্যোক্তা হওয়া শুধু ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, বরং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একজন নারী যদি উদ্যোক্তা হন, তাহলে তিনি নিজের পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা করতে পারেন, সন্তানের শিক্ষার মান উন্নত করতে পারেন, সমাজে একজন রোল মডেল হিসেবে স্থান করে নিতে পারেন।
নারীর নিজস্ব আয় থাকলে তিনি আত্মনির্ভরশীল হতে পারেন এবং নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর উন্নয়নের অন্যতম চাবিকাঠি হচ্ছে উদ্যোক্তা হওয়া।
নারী উদ্যোক্তা হওয়ার প্রস্তুতি
উদ্যোক্তা হতে চাইলে কিছু পূর্বপ্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। নারী হিসেবে উদ্যোক্তা হতে চাইলে যে ধাপগুলো অনুসরণ করা জরুরি:
১. নিজের আগ্রহ ও দক্ষতা নির্ধারণ করুন
প্রথমেই বুঝে নিতে হবে, আপনি কোন কাজ করতে ভালোবাসেন। যেমন — হস্তশিল্প, রান্না, ফ্যাশন ডিজাইন, অনলাইন পণ্য বিক্রি, গ্রাফিক ডিজাইন বা কনটেন্ট ক্রিয়েশন ইত্যাদি। একজন নারী তার শখ এবং আগ্রহকেই পেশায় রূপান্তর করতে পারেন। আগ্রহ না থাকলে ব্যবসায় সফলতা টেকসই হয় না।
২. সঠিক ব্যবসার আইডিয়া নির্বাচন
বর্তমানে ছোট পুঁজি দিয়ে অনেক ধরনের ব্যবসা শুরু করা যায়। যেমন —
- অনলাইন বুটিক
- হোমমেড খাবারের ব্যবসা
- কসমেটিকস বিক্রয়
- হ্যান্ডমেইড জুয়েলারি
- ড্রপশিপিং
- ইউটিউব বা ব্লগ চালানো
শিশুদের খেলনার দোকান
নিজের জায়গা ও সামর্থ্য অনুযায়ী উপযুক্ত ব্যবসার আইডিয়া বেছে নিতে হবে।
৩. একটি পরিকল্পনা তৈরি করুন
উদ্যোক্তা হওয়ার পূর্বে একটি সুস্পষ্ট ব্যবসা পরিকল্পনা থাকা জরুরি। এতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে:
- ব্যবসার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
- টার্গেট কাস্টমার
- মূলধন কত লাগবে
- পণ্য বা সেবার ধরন
- কিভাবে প্রচার করবেন
- লাভের সম্ভাব্যতা
এ ধরনের পরিকল্পনা ব্যবসাকে বাস্তবিক রূপ দিতে সহায়তা করে।
৪. প্রশিক্ষণ গ্রহণ করুন
বাংলাদেশে এখন অনেক সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ফ্রি বা স্বল্পমূল্যে প্রশিক্ষণের সুযোগ দেয়। যেমন —
- SME Foundation
- BSCIC
- Women and e-Commerce (WE)
- ICT Division
এই সকল সংস্থার মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা, ডিজিটাল মার্কেটিং, হিসাব রক্ষণ, ই-কমার্স বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা যেতে পারে।
নারী উদ্যোক্তার জন্য ব্যবসার ধরন
প্রথমদিকে ছোট আকারে ব্যবসা শুরু করাই শ্রেয়। কিছু জনপ্রিয় ব্যবসা নিচে দেওয়া হলো যা একজন নারী উদ্যোক্তা ঘরে বসে শুরু করতে পারেন।
১. অনলাইন বুটিক ও পোশাক ব্যবসা
বাংলাদেশে পোশাক ব্যবসার চাহিদা সবসময় থাকে। ফেসবুক বা ওয়েবসাইটে নিজের বুটিকের ছবি আপলোড করে অর্ডার নেওয়া যায়। এতে খুব অল্প পুঁজি লাগে এবং মুনাফাও ভালো।
২. হোমমেড খাবার বিক্রি
যারা রান্নায় পারদর্শী, তারা হোম ডেলিভারি সার্ভিসের মাধ্যমে খাবার সরবরাহ করতে পারেন। অফিসের জন্য লাঞ্চ বক্স, কেক, বিরিয়ানি বা দেশীয় খাবার বেশ চাহিদাসম্পন্ন।
৩. কসমেটিকস ও বিউটি প্রোডাক্ট ব্যবসা
মেয়েদের সৌন্দর্য চর্চা নিয়ে আগ্রহ থাকলে বিদেশি ও দেশি কসমেটিকস প্রোডাক্ট অনলাইনে বিক্রি করা লাভজনক। এতে হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে অর্ডার সংগ্রহ করা যায়।
৪. গ্রাফিক ডিজাইন বা ফ্রিল্যান্সিং
যারা কম্পিউটারে দক্ষ, তারা ঘরে বসেই ফাইভার, আপওয়ার্ক, ফ্রিল্যান্সার ডটকমে কাজ করে ইনকাম করতে পারেন।
৫. ইউটিউবিং বা ব্লগিং
নিজের অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান শেয়ার করে ইউটিউব বা ব্লগ চালিয়ে আয় করা যায়। এটি ধৈর্য ও সৃজনশীলতার কাজ, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে অত্যন্ত লাভজনক।
সামাজিক ও পারিবারিক চ্যালেঞ্জ
নারী উদ্যোক্তা হতে গেলে কিছু বাধা ও চ্যালেঞ্জ আসবেই। অনেক নারীই পরিবারের সমর্থন পান না, আবার কেউ কেউ সমাজের বাঁকা চোখে পড়েন।
১. পারিবারিক বাধা
মেয়েদের সবসময় ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় বলে ব্যবসার জন্য সময় বের করা কঠিন হয়। অনেক পরিবার মনে করে নারীকে ব্যবসা করা উচিত নয়।
২. আর্থিক সীমাবদ্ধতা
অনেক নারী আর্থিকভাবে স্বাধীন না হওয়ায় ব্যবসার মূলধন জোগাড় করতে সমস্যায় পড়েন।
৩. সামাজিক নিরাপত্তার অভাব
নারীদের বাইরে গিয়ে পণ্য সংগ্রহ বা ডেলিভারি করতে গেলে নিরাপত্তার ঝুঁকি থাকে।
৪. আত্মবিশ্বাসের অভাব
অনেক নারীই মনে করেন তারা ব্যবসার জন্য উপযুক্ত নন, যা তাদের নিজেকে গুটিয়ে রাখে।
এই বাধা কাটিয়ে উঠার উপায়
১. পরিবারকে বোঝানো — সফল নারী উদ্যোক্তাদের গল্প দেখিয়ে পরিবারকে আশ্বস্ত করা যায়।
২. স্বল্প পুঁজিতে শুরু করা — খুব কম পুঁজিতে ব্যবসা শুরু করা গেলে ঝুঁকিও কম থাকে।
৩. অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার — ফেসবুক, ইউটিউব, ইন্সটাগ্রাম ব্যবহার করে ঘরে বসেই ব্যবসা পরিচালনা করা যায়।
৪. নেটওয়ার্ক তৈরি করা — অন্যান্য নারী উদ্যোক্তার সাথে যুক্ত থেকে অনুপ্রেরণা ও পরামর্শ পাওয়া যায়।
৫. সরকারি ও এনজিও সাহায্য নেওয়া — বিভিন্ন সরকারি সংস্থা নারীদের জন্য বিশেষ লোন ও প্রশিক্ষণের সুযোগ দেয়।
সফল নারী উদ্যোক্তার উদাহরণ
বাংলাদেশে অনেক নারী উদ্যোক্তা আছেন, যারা শুরু করেছিলেন অল্প পুঁজিতে। যেমন —
- রুবানা হক: মোহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, যিনি দেশের একজন সফল নারী ব্যবসায়ী।
- নাসরিন হক: নারী উদ্যোক্তাদের সহায়তায় কাজ করছেন Women and e-Commerce (WE) প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে।
- তাসনুভা আনান: একটি কসমেটিকস অনলাইন শপের মাধ্যমে দেশের বাজারে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন।
উপসংহার
নারী উদ্যোক্তা হওয়া মানে শুধু একটি ব্যবসা শুরু করা নয়, বরং নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ হাতে নেওয়া, সমাজে আত্মমর্যাদা অর্জন করা এবং অন্যান্য নারীদের জন্য একটি উদাহরণ স্থাপন করা। একটি সাহসী পদক্ষেপ নিতে পারলেই নারীর জীবন বদলে যেতে পারে। বর্তমান যুগ নারীদের জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগের সময়। প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ এবং ইচ্ছাশক্তির সমন্বয়ে নারী উদ্যোক্তা হওয়া এখন আর স্বপ্ন নয়, বরং বাস্তবতা।
তাই প্রত্যেক নারীর উচিত নিজের দক্ষতা ও আগ্রহকে কাজে লাগিয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার দিকে এগিয়ে যাওয়া। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র যদি নারীর পাশে দাঁড়ায়, তাহলে বাংলাদেশ একদিন নারী উদ্যোক্তার শক্তিতে বদলে যাবে আরও সমৃদ্ধ একটি দেশে।