বর্তমান ডিজিটাল যুগে মোবাইল ফোন আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে এবং সেই সঙ্গে বাড়ছে সিম কার্ড ব্যবহারের পরিমাণও। তবে অনেকেই জানেন না যে, প্রতিটি সিম কার্ডের রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক এবং তা অবশ্যই সঠিক জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) অনুযায়ী হতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, নিজের নামে রেজিস্টার্ড না হওয়া সিম ব্যবহারের কারণে গ্রাহককে পড়তে হয় আইনি আনেক জটিলতায়। এমনকি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রেও অন্যের নামে থাকা সিম ব্যবহার হয়ে থাকে। তাই অনলাইনে সহজে নিজের সিম রেজিস্ট্রেশন স্ট্যাটাস চেক করার সুবিধাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সিম রেজিস্ট্রেশন কি এবং কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ
সিম রেজিস্ট্রেশন হলো মোবাইল সেবা প্রদানকারী কোম্পানির নিকট গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণ ও যাচাইয়ের প্রক্রিয়া। এই তথ্যের মধ্যে থাকে জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, জন্মতারিখ, ছবি এবং আঙুলের ছাপ (Biometric)। এটি মূলত সরকার এবং বিটিআরসি (বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন) দ্বারা নির্ধারিত একটি বাধ্যতামূলক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয় কোন সিম কার্ড কার নামে রেজিস্টার্ড আছে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মোবাইল ব্যবহারকারীর সুরক্ষা নিশ্চিত হয় এবং একই সঙ্গে অপরাধ দমনে সাহায্য করে। রেজিস্ট্রেশন ছাড়া সিম ব্যবহার করাটা যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, তেমনই তা এখন বেআইনি বলেও গণ্য হয়। সেজন্য প্রতিটি মোবাইল ব্যবহারকারীর উচিত নিজের নামে রেজিস্টার্ড সিমই ব্যবহার করা এবং অনলাইনে তা যাচাই করে নিশ্চিত হওয়া।
বাংলাদেশে মোবাইল অপারেটর ও রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি
বাংলাদেশে প্রধানত পাঁচটি মোবাইল অপারেটর রয়েছে – গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক, টেলিটক এবং এয়ারটেল। প্রতিটি অপারেটরের নিজস্ব রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম রয়েছে এবং প্রত্যেকেই বিটিআরসি কর্তৃক নির্ধারিত নিয়ম অনুসরণ করে। বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশনের সময় জাতীয় পরিচয়পত্র স্ক্যান করে আঙুলের ছাপ নেওয়া হয় এবং সেই অনুযায়ী সিমটি সেই গ্রাহকের নামে নিবন্ধিত হয়। তবে অনেক সময় দোকানদারদের অসতর্কতায় বা গ্রাহকের অজ্ঞতায় ভুলবশত অন্য কারো নামে সিম রেজিস্টার্ড হয়ে যায়, কিংবা একই এনআইডির অধীনে অতিরিক্ত সিম রেজিস্টার্ড থাকে, যা নির্দিষ্ট সীমার বাইরে চলে গেলে বিটিআরসি সেগুলো বন্ধ করে দিতে পারে। তাই নিজের এনআইডির অধীনে কতগুলো সিম নিবন্ধিত আছে তা জানা ও প্রয়োজনে অপ্রয়োজনীয় সিম বন্ধ করাটা জরুরি।
অনলাইনে সিম রেজিস্ট্রেশন চেক করার সুবিধা
আগে সিম রেজিস্ট্রেশন তথ্য জানার জন্য মোবাইল অপারেটরের কাস্টমার কেয়ারে যেতে হতো, কিংবা দোকানে গিয়ে আবারও বায়োমেট্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হতো। কিন্তু এখন প্রযুক্তির উন্নতির ফলে ঘরে বসেই খুব সহজে মোবাইল বা কম্পিউটার থেকে নিজের এনআইডির অধীনে নিবন্ধিত সিমের সংখ্যা ও তথ্য অনলাইনে জানা যায়। এটি সময় বাঁচায়, হয়রানি কমায় এবং সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে – ব্যবহারকারী নিজেই তার তথ্য যাচাই করে সচেতন হতে পারেন। বিভিন্ন অপারেটরের ওয়েবসাইটে বা নির্ধারিত কোড পাঠিয়ে আপনি মুহূর্তেই জানতে পারবেন আপনার এনআইডির অধীনে কতটি সিম আছে এবং কোন অপারেটরের সিমগুলো রয়েছে।
বিটিআরসির নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী সিম সীমা
বর্তমানে একজন ব্যক্তি তার একটি জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে সর্বোচ্চ ১৫টি সিম নিবন্ধন করতে পারেন, যেগুলো বিভিন্ন অপারেটরের হতে পারে। এই সীমার অতিরিক্ত যদি কোনো সিম থাকে, তবে বিটিআরসি তা বাতিল করতে পারে বা স্থগিত রাখতে পারে। অনেকেই হয়তো জানেন না, তাদের এনআইডির ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন সময়ে দোকান থেকে সিম নিবন্ধিত হয়েছে, যেগুলো হয়তো তারা নিজেরাও ব্যবহার করছেন না। তাই এই অতিরিক্ত সিমগুলো যদি সময়মতো বাতিল বা অফ না করা হয়, তাহলে তা অন্য কেউ ব্যবহার করে অপরাধমূলক কাজে লাগাতে পারে। এমন অবস্থায় মূল মালিক হিসেবে গ্রাহককেই ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
( আপনি চাইলে ঘরে বসে প্যাসিভ ইনকাম করুন ৭টি উপায়ে )
গ্রামীণফোন সিম রেজিস্ট্রেশন চেক অনলাইন
গ্রামীণফোন গ্রাহকরা অনলাইনে কিংবা মোবাইল থেকে খুব সহজেই নিজের এনআইডির অধীনে রেজিস্টার্ড সিম চেক করতে পারেন। মোবাইল থেকে *16001# ডায়াল করে মেনুতে গিয়ে ‘Information’ বা ‘Check NID’ অপশনটি সিলেক্ট করলে আপনি এনআইডি দিয়ে কতটি সিম রেজিস্টার্ড হয়েছে তা জানতে পারবেন। এছাড়া SMS অপশনে গিয়ে “info” লিখে 16001 নম্বরে পাঠালেও একই তথ্য চলে আসে। এ ছাড়া গ্রামীণফোনের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে গিয়ে আপনার এনআইডি নম্বর দিয়ে লগ ইন করে দেখতে পারেন কোন কোন নাম্বার রেজিস্টার্ড রয়েছে।
রবি ও এয়ারটেল সিম রেজিস্ট্রেশন চেক অনলাইন
রবি এবং এয়ারটেল, যেহেতু একই কোম্পানির অধীনে পরিচালিত হয়, তাদের রেজিস্ট্রেশন যাচাই করার পদ্ধতিও একই রকম। আপনি 16003# ডায়াল করে জানতে পারবেন আপনার এনআইডির অধীনে কতটি সিম রেজিস্টার্ড হয়েছে। এছাড়া রবি ও এয়ারটেলের সিমের অফিসিয়াল অ্যাপ থেকেও আপনি মাই নাম্বার
সেকশনে গিয়ে সিমের রেজিস্ট্রেশন সেটিং দেখতে পারবেন। এ ছাড়া তাদের ওয়েবসাইটেও OTP যাচাইয়ের মাধ্যমে এনআইডি ভিত্তিক সিম সংখ্যা তথ্য দেখা সম্ভব।
বাংলালিংক সিম রেজিস্ট্রেশন চেক অনলাইন
বাংলালিংক ব্যবহারকারীরা 16002# ডায়াল করে নিজের এনআইডির অধীনে কতটি সিম রয়েছে তা জানতে পারবেন। এছাড়া “MyBL” অ্যাপ বা বাংলালিংকের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ব্যবহার করেও আপনি একই তথ্য দেখতে পারবেন। বাংলালিংক তাদের গ্রাহকদের জন্য এই পরিষেবাগুলো অত্যন্ত সহজ ও দ্রুতগতিসম্পন্ন করেছে, যেন সবাই নিজের রেজিস্ট্রেশন তথ্য সুরক্ষিত রাখতে পারে।
টেলিটক সিম রেজিস্ট্রেশন চেক অনলাইন
টেলিটক, যেহেতু বাংলাদেশে এটি সরকারি অপারেটর, তারা এনআইডির অধীনে নিবন্ধিত সিম চেক করার জন্য একটি নির্দিষ্ট ওয়েবসাইট রেখেছে my.teletalk.com.bd। এখানে গিয়ে আপনি আপনার জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর ও জন্মতারিখ দিয়ে লগইন করলে জানতে পারবেন আপনার নামে কয়টি সিম রেজিস্টার্ড রয়েছে। এটি বিশেষভাবে শিক্ষার্থীদের জন্যও উপকারী যারা বিভিন্ন সরকারি সেবা টেলিটকের মাধ্যমে গ্রহণ করেন।
নিজের নামে কতটি সিম আছে তা অনলাইনেই জানা সম্ভব
অনেক সময় আমরা জানিই না আমাদের এনআইডিতে কয়টি সিম রেজিস্টার্ড আছে। কেউ হয়তো একবার সিম কিনেছেন এবং পরবর্তীতে তা হারিয়ে ফেলেছেন। অথবা দোকানদার ভুল করে অন্য নাম্বারে রেজিস্ট্রেশন করেছেন। এসব সমস্যা এখন অনলাইনে খুব সহজে সমাধান করা যায়। বিটিআরসির নির্ধারিত ওয়েবসাইট লিংক simregistration.info এই ঠিকানায় গিয়ে আপনি নিজের জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর এবং জন্মতারিখ দিয়ে লগইন করে সব অপারেটরের রেজিস্টার্ড সিম এক জায়গায় দেখে নিতে পারবেন। এই প্ল্যাটফর্মটিকে কেন্দ্রীয় সিম রেজিস্ট্রেশন যাচাই পদ্ধতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
অনলাইন রেজিস্ট্রেশন চেকের মাধ্যমে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন
নিজের নামে কয়টি সিম রয়েছে, তা জানার মাধ্যমে আপনি একদিকে যেমন অপ্রয়োজনীয় সিম বাতিল করতে পারবেন, অন্যদিকে কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের দায় থেকেও নিজেকে নিরাপদ রাখতে পারবেন। কারণ আপনি যদি কোনো অপরিচিত নম্বর খুঁজে পান যা আপনার এনআইডিতে রেজিস্টার্ড, তাহলে সাথে সাথে মোবাইল অপারেটরের কাস্টমার কেয়ারে যোগাযোগ করে তা বাতিল করতে পারবেন। এতে ভবিষ্যতের ঝামেলা অনেকটাই এড়ানো সম্ভব হবে।
সিম রেজিস্ট্রেশন সংশোধন ও বাতিলের পদ্ধতি
যদি আপনি অনলাইনে চেক করার পর দেখেন যে আপনার এনআইডির অধীনে কোনো অপ্রয়োজনীয় বা অজানা সিম রেজিস্টার্ড রয়েছে, তাহলে তা বাতিল করতে হবে। এই জন্য আপনাকে মোবাইল অপারেটরের কে কাস্টমার কেয়ারে যোগাযোগ করতে হবে। আপনি চাইলে প্রথমে আপনার কাছের কাস্টমার কেয়ার সেন্টারে গিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে আপনার সেই সিম বাতিল করতে পারবেন। কিছু ক্ষেত্রে অনলাইন থেকেই “Deactivate Unwanted SIM” অপশন চালু রয়েছে, যেটা ব্যবহার করে ঘরে বসেই নির্দিষ্ট নম্বর বাতিল করা যায়।
উপসংহার
ডিজিটাল বাংলাদেশে নিজের পরিচয় পত্র , ব্যক্তিগত তথ্য ও নিরাপত্তা রক্ষা করার অন্যতম উপায় হলো নিজের মোবাইল সিম রেজিস্ট্রেশন তথ্য সচেতনভাবে যাচাই করা। অনলাইনে সিম রেজিস্ট্রেশন চেক করার এই সহজ পদ্ধতিগুলো আমাদেরকে যেমন সময় ও খরচ সাশ্রয় করে, তেমনি আইনগত সমস্যাও এড়াতে সাহায্য করে। দেশের প্রতিটি মোবাইল ব্যবহারকারীর উচিত নিয়মিতভাবে নিজের এনআইডির অধীনে রেজিস্টার্ড সিমগুলোর অবস্থা যাচাই করে দেখা এবং যদি প্রয়োজন হয় তাহলে অপ্রয়োজনীয় বা অজানা সিম বাতিল করে দেওয়া উচিত। নিজে সচেতন হোন এবং অন্নকে সচেতন হয়ার আদেস করুন এবং নিজের মোবাইল সিম ব্যবহারে নিরাপদ থাকুন।