প্রতিটি দেশেই ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার জন্য কিছু নিয়মকানুন ও আইন অনুসরণ করতে হয়। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। একজন ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তা যখন ব্যবসা শুরু করেন, তখন তার প্রথম দায়িত্ব হয় ব্যবসাটি বৈধ করার। ব্যবসার বৈধতা নিশ্চিত করার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ট্রেড লাইসেন্স প্রাপ্তি। এটি একটি সরকারি নথি যা ব্যবসাকে আইনগত স্বীকৃতি প্রদান করে।
বাংলাদেশে অনেক মানুষ জানেন না যে, ব্যবসা করার জন্য ট্রেড লাইসেন্স বাধ্যতামূলক। ফলে অনেকেই অজান্তে বেআইনি ব্যবসা পরিচালনা করছেন, যা ভবিষ্যতে জটিলতা তৈরি করতে পারে। এই রচনায় আমরা বিস্তারিতভাবে জানব ট্রেড লাইসেন্স কী, এটি কেন দরকার, কীভাবে করতে হয়, কী কাগজপত্র লাগে, খরচ কেমন, এবং কী সমস্যা হতে পারে।
ট্রেড লাইসেন্স কী?
ট্রেড লাইসেন্স হলো একটি সরকার অনুমোদিত সনদপত্র যা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে ব্যবসা পরিচালনার আইনি অনুমতি প্রদান করে। এটি সাধারণত সংশ্লিষ্ট সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, বা ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক প্রদান করা হয়। লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা পরিচালনা করলে তা আইনত অবৈধ হিসেবে গণ্য হয়।
ট্রেড লাইসেন্সের গুরুত্ব
ট্রেড লাইসেন্স শুধু একটি কাগজ নয়, এটি ব্যবসার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। এর গুরুত্ব অনেক দিক থেকে বিশ্লেষণ করা যায়:
- আইনগত স্বীকৃতি: ব্যবসার বৈধতা প্রতিষ্ঠিত হয় ট্রেড লাইসেন্সের মাধ্যমে।
- ব্যাংক একাউন্ট খোলা: ব্যবসায়িক ব্যাংক একাউন্ট খোলার জন্য এটি অপরিহার্য।
- টেন্ডার বা সরকারি প্রজেক্ট: সরকারি বা বেসরকারি টেন্ডার অংশগ্রহণে ট্রেড লাইসেন্স প্রয়োজন।
- ভ্যাট ও ট্যাক্স রেজিস্ট্রেশন: ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসায়িক ভ্যাট ও ট্যাক্স রেজিস্ট্রেশন সম্ভব নয়।
- বিশ্বাসযোগ্যতা: কাস্টমার, সাপ্লায়ার ও ব্যবসায়িক পার্টনারদের কাছে লাইসেন্সধারী ব্যবসা বেশি গ্রহণযোগ্যতা পায়।
বাংলাদেশে ট্রেড লাইসেন্স প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান
বাংলাদেশে যেখানেই আপনি ব্যবসা শুরু করুন না কেন, সেখানকার স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হবে। যেমন:
- ঢাকা সিটি কর্পোরেশন (উত্তর/দক্ষিণ) – রাজধানী এলাকার জন্য
- পৌরসভা (Municipality) – জেলা শহরের জন্য
- ইউনিয়ন পরিষদ – গ্রামাঞ্চলের জন্য
প্রতিটি সংস্থা তাদের নিজস্ব নিয়ম অনুযায়ী আবেদন গ্রহণ করে এবং লাইসেন্স প্রদান করে।
ট্রেড লাইসেন্স করার ধাপসমূহ (Step-by-step)
নিচে সাধারণভাবে ট্রেড লাইসেন্স করার ধাপগুলো তুলে ধরা হলো:
ধাপ ১: ব্যবসার ধরণ নির্ধারণ
আপনার ব্যবসাটি কি হবে – দোকান, সেবা ভিত্তিক, নির্মাণ, পরিবহন, রেস্টুরেন্ট, কিংবা অনলাইন ভিত্তিক? ট্রেড লাইসেন্সে ব্যবসার ধরন উল্লেখ করতে হবে।
ধাপ ২: স্থানীয় কর্তৃপক্ষ খুঁজে বের করা
আপনার ব্যবসার অবস্থান যেখানেই হোক, সেই এলাকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ (সিটি কর্পোরেশন/পৌরসভা/ইউনিয়ন পরিষদ) খুঁজে নিতে হবে।
ধাপ ৩: আবেদন ফর্ম সংগ্রহ করা
আপনি চাইলে সরাসরি অফিসে গিয়ে অথবা সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইট থেকে ট্রেড লাইসেন্স আবেদন ফর্ম সংগ্রহ করতে পারেন।
ধাপ ৪: প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত করা
সঠিকভাবে ফর্ম পূরণ করে নিচের কাগজপত্রসহ দাখিল করতে হবে।
ট্রেড লাইসেন্স করতে যেসব কাগজপত্র দরকার
ব্যবসার ধরন ও অবস্থানভেদে কিছু পরিবর্তন হতে পারে, তবে সাধারণত নিচের কাগজপত্র দরকার হয়:
- জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) / পাসপোর্টের কপি
- পাসপোর্ট সাইজ ছবি (২ কপি)
- ব্যবসা স্থানের ঠিকানা / ভাড়ার চুক্তিপত্র (প্রয়োজন হলে)
- ব্যবসার নাম ও প্রকৃতি
- ট্যাক্স সার্টিফিকেট (যদি থাকে)
- চেম্বার অব কমার্স বা অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যপত্র (প্রয়োজনে)
- প্রতিষ্ঠানের লেটারহেড / প্যাড
- দোকানের ছবি / দোকান নম্বর
- আগের বছরের ট্রেড লাইসেন্স (নতুন নয়, রিনিউয়ের ক্ষেত্রে)
বর্তমানে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ওয়েবসাইটে ট্রেড লাইসেন্সের জন্য অনলাইনে আবেদন করা যায়।
ওয়েবসাইট:
প্রক্রিয়া:
১. ওয়েবসাইটে গিয়ে “ট্রেড লাইসেন্স” অপশন সিলেক্ট করুন।
২. ফর্ম পূরণ করুন ও প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট আপলোড করুন।
৩. ফি জমা দিন (অনলাইনে পেমেন্ট বা ব্যাংকে)।
৪. যাচাই-বাছাই শেষে লাইসেন্স ইস্যু হবে।
ট্রেড লাইসেন্সের খরচ কেমন?
ট্রেড লাইসেন্সের খরচ ব্যবসার ধরন ও অবস্থানের ওপর নির্ভর করে। নিচে একটি ধারনা দেওয়া হলো:
ব্যবসার ধরন | লাইসেন্স ফি (বাৎসরিক) |
ছোট দোকান বা খুচরা বিক্রেতা | ৫০০–১৫০০ টাকা |
মাঝারি প্রতিষ্ঠান | ২০০০–৫০০০ টাকা |
রেস্টুরেন্ট / হোটেল | ৫০০০–১০,০০০ টাকা |
কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান | ১৫,০০০+ টাকা |
সাথে অতিরিক্ত ভ্যাট, রিনিউ ফি ও সার্ভিস চার্জ যুক্ত হতে পারে।
ট্রেড লাইসেন্স রিনিউ করার নিয়ম
প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেড লাইসেন্স রিনিউ করতে হয়। সাধারণত জানুয়ারি–মার্চের মধ্যে রিনিউ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। রিনিউ না করলে জরিমানা হতে পারে এবং ব্যবসা বন্ধ করার নির্দেশনাও আসতে পারে।
রিনিউয়ের জন্য দরকার হয়:
- পূর্বের ট্রেড লাইসেন্স কপি
- NID কপি
- রিনিউ ফি (যা নির্ধারিত হয়)
- ব্যাংক চালান বা পেমেন্ট রসিদ
ট্রেড লাইসেন্স করতে যে সমস্যাগুলো হয়
১. দালালের ভোগান্তি:
অনেকেই সরাসরি অফিসে না গিয়ে দালালের মাধ্যমে ট্রেড লাইসেন্স করতে গিয়ে প্রতারিত হন।
২. ঘুষ ও বিলম্ব:
কিছু এলাকায় দুর্নীতির কারণে লাইসেন্স পেতে বিলম্ব হয়।
৩. অনলাইনে জটিলতা:
সব এলাকার জন্য এখনো অনলাইন ট্রেড লাইসেন্স সুবিধা চালু হয়নি বা কার্যকর নয়।
৪. তথ্য ঘাটতি:
অনেকের কাছে স্পষ্ট তথ্য না থাকায় ভুল ফর্ম পূরণ বা ডকুমেন্টে সমস্যা হয়।
সমাধান ও পরামর্শ
- নিজে অফিসে গিয়ে বা অফিসিয়াল ওয়েবসাইট দেখে আবেদন করুন।
- প্রয়োজনে স্থানীয় কাউন্সিলরের সাহায্য নিতে পারেন।
- সঠিক তথ্য জেনে আবেদন করলে সময় ও টাকা দুই-ই বাঁচে।
- ব্যবসা ছোট হলেও ট্রেড লাইসেন্স নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
উপসংহার
ট্রেড লাইসেন্স ব্যবসার বৈধ অস্তিত্বের প্রতীক। এটি না থাকলে ব্যবসা যেমন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে, তেমনি ভবিষ্যতে ব্যাংক ঋণ, ভ্যাট, ট্যাক্স, ইনভেস্টমেন্ট বা যে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা পেতে সমস্যা হয়। তাই ছোট হোক বা বড়, যে কোনো ব্যবসা শুরু করার আগে অবশ্যই ট্রেড লাইসেন্স নিতে হবে।
সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে চাইলে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে একজন দায়িত্বশীল ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চাইলে ট্রেড লাইসেন্সের গুরুত্ব অপরিসীম। সরকারের পক্ষ থেকেও লাইসেন্স প্রক্রিয়া সহজতর করা হচ্ছে, যাতে সব ব্যবসায়ী অনায়াসে এটি করতে পারেন।
সুতরাং, যারা নতুন ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছেন কিংবা যারা এখনো লাইসেন্স নেননি, তাদের উচিৎ দেরি না করে দ্রুত ট্রেড লাইসেন্সের আবেদন করা — কারণ এটি শুধু একটি লাইসেন্স নয়, বরং আপনার ব্যবসার সম্মানের সনদ।